ফ্রাউনখিয়ের্কে (সম্পূর্ণ নাম: জার্মান: Dom zu Unserer Lieben Frau, আক্ষ. 'ক্যাথেড্রাল অব আওয়ার লেডি') জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যের মিউনিখ শহরের একটি গির্জা। এটি মিউনিখ ও ফ্রেইসিনের আর্চডিওসেসের ক্যাথেড্রাল ও এর আর্চবিশপের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্থাপনাটি বাভারিয়ার রাজধানীর প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। একে মিউনিখ ক্যাথেড্রাল (জার্মান: Münchner Dom) বলা হলেও স্থানীয়ভাবে এটি "ফ্রাউনখিয়ের্কে" নামে পরিচিত।
স্থানীয় উচ্চতার সীমার কারণে গির্জার টাওয়ারসমূহ ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। নগর প্রশাসনের নির্দেশ অনুযায়ী শহরের কেন্দ্রে ৯৯ মিটারের বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যায় না। ২০০৪ সালের নভেম্বর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে। দক্ষিণ টাওয়ারটি সাধারণত উপরে উঠার জন্য খোলা থাকে। এখান থেকে মিউনিখ ও নিকটস্থ আল্পসের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
১২শ শতাব্দীতে শহরের প্রথম ধাপের দেয়ালের পাশে একটি রোমানস্ক স্থাপত্যের গির্জা নির্মিত হয়। ইতিপূর্বে এখানে শহরের একটি পেরিশ গির্জা ছিল। ১৫শ শতাব্দীতে পূর্বের ভবনের স্থলে বর্তমান গোথিক স্থাপত্যটি এখানে স্থান করে নেয়। ডিউক সিগিসমুন্ড ও মিউনিখের জনগণ এতে পৃষ্ঠপোষকতা করে।
জর্জ ভন হালসবাখ ২০ বছর সময়ের মধ্যে ক্যাথেড্রালটি নির্মাণ করেন। অর্থনৈতিক কারণ ও স্থানীয় পাথরের স্বল্পতার দরুন নির্মাণ উপকরণ হিসেবে এতে ইট ব্যবহার করা হয়। ১৪৬৮ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৪৭৯ সালে নগদ সম্পদ শেষ হয়ে যাওয়ায়, তৎকালীন চতুর্থ পোপ সিক্স্টাস এর জন্য আনুকূল্য প্রদান করেছিল।
দুইটি টাওয়ারের মধ্যে উত্তরের টাওয়ারটি ৯৮.৫৭ মিটার (৩২৩.৪ ফু) উঁচু, যেখানে দক্ষিণের টাওয়ারটির এর থেকে ০.১২ মিটার (৪.৭ ইঞ্চি) ছোটো। টাওয়ার দুটি ১৪৮৮ সালে নির্মাণ শেষ হয়। ১৪৯৪ সালে গির্জা খুলে দেওয়া হয়। তবে অর্থ স্বল্পতার কারণে গোথিক শৈলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কৌণিক চূড়া নির্মাণ সম্পন্ন করা সম্ভব হয় নি। ফলে ১৫২৫ সাল পর্যন্ত টাওয়ারের নির্মাণ অসমাপ্ত ছিল। হার্টমান স্কেডেল তার বিখ্যাত মিউনিখ ক্রনিকলে (স্কেডেল'স ওয়ার্ল্ড ক্রনিকল নামে পরিচিত) উন্মুক্ত টাওয়ার সহ মিউনিখের দৃশ্য ছাপিয়েছিলেন। বৃষ্টির পানি ভেতরে প্রবেশ করায় এবং টাওয়ারের ছাদে পানি জমার কারণে বাজেটের মধ্যে নির্মাণ সমাপ্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ফলে টাওয়ার দুটির উপরে গম্বুজ নির্মিত হয় যা গির্জার আলাদা বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠে। গম্বুজের নকশা জেরুসালেমের কুব্বাত আস-সাখরার আদলে প্রণীত হয়েছিল। যার ফলে এতে বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের আদল সৃষ্টি হয়, যা সেই সময়ে ভূলবশত সলোমনের মূল মন্দির বলে বিবেচিত হয়েছিল।
ভবনের আয়তন প্রায় ২,০০,০০০ ঘনমিটার (৭১,০০,০০০ ঘনফুট) ঘন মিটার। এখানে একসঙ্গে প্রায় ২০,০০০ মানুষ দাঁড়াতে পারত। পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের জন্য গির্জায় বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটি একটি শহরের জন্য অসাধারণ ছিল যে, এটি ছাড়াও পাশাপাশি অন্য (প্রথম) প্যারিশ গির্জা ১৫শ শতাব্দীর শেষের দিকে মাত্র ১৩,০০০ অধিবাসীদের গণনা করা হয়েছিল এবং একটি গির্জা যা একটি সাধারণ (দ্বিতীয়) নগর প্যারিশের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনীর বিমান হামলার ফলে ক্যাথেড্রালের ভবন ভয়াবহ ক্ষতির স্বীকার হয়। এসময় ক্যাথেড্রালের ছাদ ধ্বংস হয়ে যায় এবং একটি টাওয়ার ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভবনের ধ্বংস হয়ে যাওয়া অংশ সরানোর সময় ভেতরের অনেক পুরনো মূল্যবান অংশ হারিয়ে যায়।
যুদ্ধের পর কয়েক ধাপে বৃহদাকারে পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে নির্মাণের শেষ ধাপ সমাপ্ত হয়।
ফ্রাউনখিয়ের্কে লাল ইটের গোথিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি যার নির্মাণে ২০ বছর সময় লেগেছিল। গোথিক স্থাপত্যরীতিতে সমৃদ্ধ অলঙ্করণ থাকলেও ভবনটি সাধারণভাবে নির্মিত হয়েছে। ফলে বিশেষ আকৃতির দুইটি টাওয়ার সহ ভবনটি দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠে। গির্জার টাওয়ার দুটি একসঙ্গে বিশেষ নকশায় তৈরি হয়েছিল।
ভবনের দীর্ঘ ১০৯ মিটার (৩৫৮ ফু), প্রস্থ ৪০ মিটার (১৩০ ফু), এবং ৩৭ মিটার (১২১ ফু)। প্রচলিত মতানুযায়ী টাওয়ার দুটির একটি অপরটি থেকে এক মিটার ছোট হলেও বাস্তবে এদের উচ্চতার পার্থক্য ১২ সেন্টিমিটার (৪.৭ ইঞ্চি)। উত্তরের টাওয়ারের উচ্চতা ৯৮.৫৭ মিটার (৩২৩.৪ ফু) এবং দক্ষিণের টাওয়ারের উচ্চতা ৯৮.৪৫ মিটার (৩২৩.০ ফু)। মূল নকশায় কৌণিক চূড়ার থাকলেও নির্মাণের সময় অর্থ স্বল্পতার কারণে তা নির্মিত হয় নি। বরং রেনেসার সময় এতে গম্বুজ সংযুক্ত হয়। এটি ভবনকে একটি পৃথক বৈশিষ্ট্য দান করেছেন।
দক্ষিণ জার্মানির হল গির্জাসমূহের মধ্যে এই গির্জা সর্ববৃহৎ। হলটি ৩টি অংশে বিভক্ত। এর মধ্যে রয়েছে একটি মূল কেন্দ্রীয় অংশ এবং দুইটি পার্শ্বীয় অংশ। পার্শ্বীয় অংশের উচ্চতা ৩১ মিটার (১০২ ফু) এবং এতে প্রতি পাশে ১১টি করে ২২টি স্তম্ভ রয়েছে। হেনরিখ ভন স্ট্রবিন আর্চের নকশা প্রণয়ন করেছিলেন।
১৪শ ও ১৫শ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য শিল্পী যেমন পিটার কেন্ডিড, এরাসমাস গ্রেসার, জেন পোলাক, হান্স লেইনবার্গার, হান্স ক্রাম্পার ও ইগনাজ গুন্টারের শিল্পকর্ম গির্জার অভ্যন্তরের অলঙ্করণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
অভ্যন্তরের অধিকাংশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। এসময় প্রবেশপথে অবস্থিত টিউফেলস্ট্রিট বা শয়তানের পদচিহ্ন নামে পরিচিত আকর্ষণটি টিকে গিয়েছিল। এটি পায়ের ছাপাকৃতির একটি কালো চিহ্ন। কিংবদন্তী অনুসারে হালসবাখ জানালাবিহীন গির্জা নির্মাণ করায় শয়তান এখানে দাঁড়িয়ে উপহাস করেছিল। (বারুক যুগে উঁচু বেদি কর্তৃক গির্জার শেষপ্রান্তের জানালা ঢাকা পড়ে যেত)।
আরেকটি কিংবদন্তী অনুসারে, শয়তান নির্মাতার সাথে এই শর্তে অর্থায়ন করার চুক্তি করে যে গির্জাতে কোনো জানালা থাকবে না। বুদ্ধিমান নির্মাতা এমনভাবে স্তম্ভের অবস্থান নির্ধারণ করেন যে শয়তান যখন প্রবেশপথে দাঁড়ায় তখন সে জানালা দেখতে পায়নি। কিন্তু নির্মাতার চালাকি ধরতে পারার পর সে আর গির্জায় ঢুকতে পারেনি। শয়তান শুধু প্রবেশপথে দাঁড়াতে সক্ষম হয় এবং রাগান্বিত অবস্থায় মেঝেতে আঘাত করে যার ফলে সেখানে পায়ের ছাপ বসে যায়।
কিংবদন্তীতে একথাও রয়েছে যে এরপর শয়তান বাইরে বেরিয়ে যায় এবং গির্জার চারপাশের বাতাসকে রাগান্বিত করে তোলে।
অন্য একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী শয়তান বাতাসে ভর করে গির্জার নির্মাণ দেখতে এসে রেগে গিয়ে বাতাসকে ফেলে ফেরত চলে যায় ফলে সে পুনরায় এসে এটি দাবি করার পূর্ব পর্যন্ত বাতাস গির্জার চারপাশে প্রবাহিত হতে থাকবে।
গির্জায় মিউনিখ ও ফ্রেইসিনের আর্চবিশপদের কবর এবং ভিটলসবাখ রাজবংশের সদস্যদের দাফন করা হয়েছে। তারা হলেন:
বর্তমান অর্গানগুলো ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে জর্জ জেন কর্তৃক নির্মিত হয়। বৃহৎ অর্গানটিতে ৯৫টি স্টপ (১৪০টি র্যাঙ্ক, ৭১৬৫টি পাইপ) রয়েছে। কোয়ার অর্গানটি ডানদিকের অংশে অবস্থিত। এতে ৩৬টি স্টপ (৫৩টি র্যাঙ্ক) রয়েছে। দুইটি অর্গানে ১৩১টি স্টপ (১৯৩টি র্যাঙ্ক ও ৯৮৩৩টি পাইপ) রয়েছে যা মিউনিখের সর্ববৃহৎ অর্গানের সমন্বয়। দৈনিক প্রার্থনার সময় অর্গানগুলো বাজানো হয়। এছাড়াও জুলাইয়ের প্রথমভাগ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত ক্যাথেড্রালের বার্ষিক কনসার্ট সিরিজের সময় তা বাজানো হয়।
দুইটি টাওয়ারে দশটি ঘন্টা রয়েছে। এগুলো ১৪শ ,১৫শ, ১৭শ ও ২১শ শতাব্দীতে নির্মিত। সবচেয়ে ভারি ঘন্টার নাম সুসান্না বা সালভেগলোক এবং এটি বাভারিয়ার সর্ববৃহৎ ঘন্টা। ১৪৯০ সালে ডিউক চতুর্থ আলবার্টের নির্দেশে হান্স আরনেস্ট এটি নির্মাণ করেন।
নং. |
অডিও |
নাম |
নির্মাণকাল, নির্মাতা, নির্মাণস্থল |
ব্যাস (mm) |
ভর (কেজি) |
নোট (সেমিটোন-১/১৬) |
টাওয়ার |
১ | সুসান্না (সালভেগলোক) | ১৪৯০, হান্স আর্নেস্ট, রেজেন্সবার্গ | ২.০৬০ | ≈৮.০০০ | a০ | +৩উত্তর | |
২ | ফ্রাওয়েনলোক | ১৬১৭, বারথোলোমাইস ওয়েঙ্গল, মিউনিখ |
১.৬৬৫ | ≈৩.০০০ | c১ | +৬উত্তর | |
৩ | বেনোগলোক | ১.৪৭৫ | ≈২.১০০ | d১ | +৭দক্ষিণ | ||
৪ | উইঙ্কলেরিন | ১৪৫১, মেইস্টার পওলাস, মিউনিখ | ১.৪২০ | ≈২.০০০ | e♭১ +১৫ | উত্তর | |
৫ | প্রেসেঞ্জলোক | ১৪৯২, উলরিচ ভন রোসেন, মিউনিখ | ১.৩২০ | ≈১.৬০০ | e১ | +৯দক্ষিণ | |
৬ | ক্যান্টাবোনা | ২০০৩, রুডলফ পারনার, পাসাও | ১.০৮০ | ৮৭০ | g১ | +১২দক্ষিণ | |
৭ | ফ্রুহমেসলোক | ১৪৪২, মেইস্টার পওলাস, মিউনিখ | ১.০৫০ | ≈৮০০ | a১ | +১০দক্ষিণ | |
৮ | স্পেকিওসা | ২০০৩, রুডলফ পারনার, পাসাও |
৮৯০ | ৫৪০ | b১ | +১০দক্ষিণ | |
৯ | মাইকেলসলোক | ৮৪০ | ৪৪০ | c২ | +১২দক্ষিণ | ||
১০ | ক্লিঙ্গল (ক্রোহেরেঞ্জলোক) | ১৪শ শতাব্দী, অজ্ঞাত | ৭৪০ | ≈৩৫০ | e♭২ +১৩ | দক্ষিণ |
১৯৮০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে মিউনিখ ফ্রাউনখিয়ের্কেের উত্তর টাওয়ারে জার্মান বৈদেশিক গোয়েন্দা সেবা বিএনডি ও আরেকটি ভিন্ন গুপ্তচর পরিষেবার একটি বেতার রিলে স্টেশন রয়েছে।