ছর্টেন স্মৃতিস্তম্ভ, এছাড়াও থিম্পু ছর্টেন নামেও পরিচিত, ভূটানের রাজথানী থিম্পু শহরের দক্ষিণ-মধ্য অংশের দোয়েবুম লামে অবস্থিত একটি স্মারক স্তুপা। ভারতীয় সেনা হাসপাতালের মুল গোলচক্করের নিকট এটি অবস্থিত। স্তুপাটি ১৯৭৪ সালে ভূটানের তৃতীয় রাজা দ্রুক গিয়ালপো জিগমে দর্জি ওয়াংচুকের সম্মানে নির্মিত হয়। স্বর্ননির্মিত চুড়া এবং ঘণ্টা সম্বলিত এই স্মৃতিসৌধ ভুটানের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। ২০০৮ সালে এটির বড় ধরনের সংস্কার করা হয়। বলা হয় ভুটানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্মীয় দর্শনীয় স্থান হচ্ছে এই স্মারক স্তুপা। দুজম জিগড্রাল ইয়েশে দর্জি কর্তৃক এটি প্রতিষ্ঠাপিত হয়েছিল।
এই স্তুপা অন্য অনেক স্মারক স্তম্ভের মতো কোন মানুষের দেহাবশেষ ধারণ করেনা। শুধুমাত্র রাজার কিছু উৎসবমুখর ছবি এর নিচতলার শোভা বর্ধন করছে। তিনি জীবিত থাকাকালীন জিগমে দর্জি এমন একটি স্মারক স্তম্ভ তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা বুদ্ধের মনের প্রতিনিধিত্ব করবে।
তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম সংস্কতির প্রচলিত র্ন্যিং-মা ধারার অনুসরনে ছর্টেন স্মৃতিস্তম্ভের ধারণা প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন আধ্যাতিক গুরু থিনলে নরবু রিনপোচে। ১৯৭৪ সালে তৃতীয় রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকের স্মরণে এটা নির্মাণ করা হয়, যিনি ১৯৭২ সালে মারা যান। এই স্মৃতিস্তম্ভের আর্থিক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জিগমে দর্জির মা ফুংসটো চোদেন।
জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ন্যাশনাল রেফারাল হাসপাতালের একটু উত্তরে চতুর্দিকে সড়ক বেস্টিত প্রায় ত্রিকেনোকৃত্রির ভূমি নিয়ে থিম্পু স্মৃতিস্তম্ভের অবস্থান। উত্তর-দক্ষিণ অক্ষে বরারর মাঝামাঝি মুল স্তুপার অবস্থান। পিছনে, অর্থাৎ দক্ষিণে আলাদা প্রার্থনা কক্ষ রয়েছে। উত্তর দিকে কমপ্লেক্সের প্রধান পবেশ পথ এবং মুল স্তুপার মাঝখানে একটি অস্টভূজাকৃতির পোর্টিকোর অবস্থান।
ছর্টেন স্মৃতিস্তম্ভ স্তুপা স্থাপত্যশৈলীর কারণে শহরের অন্যতম দর্শনীয় ধর্মীয় স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত। শহরের প্রাণকেন্দ্রে তিব্বতি স্থাপত্যের অনন্য এই উদাহরণকে এছাড়াও জাংচাপ ছর্টেনও বলা হয়, যেটির পিরামিড আকৃতির স্তম্ভের চূড়ায় একটি ধ্রুপদী চাঁদ এবং সূর্যের প্রতিকৃতি নকশাকৃত। যে বৈশিষ্ট একে আলাদা করেছে তা হচ্ছে একটি গম্বুজের আকারের পরিবর্তে ফুলদানির আকার (পিরামিড আকৃতি) দেওয়ার জন্য বৃত্তাকার অংশটির বাহ্যিক স্ফুরণ।
মুল স্মারকস্তম্ভে একটি বড় শ্বেত বর্ণের স্তুপা কাঠামো রয়েছে যার শীর্ষে স্বর্নালী চুড়া এবং সম্মুখ বারান্দা ছাদের উপরেও একই রকমের চুড়া অবস্থিত। একটি ছোট বাগানের মধ্যে এটি অবস্থিত যার মুল ভিত্তি খানিকটা উচু। ফটকের বাহিরের দিকে প্রতিনিধিত্বকারী তিনজন বোধিসত্ত্ব রয়েছে, যাদের একজন অবলোকিতেশ্বর বা সমবেদনার প্রতীক, দ্বিতীয়জন মঞ্জশ্রী বা জ্ঞানের প্রতীক এবং তৃতীয়জন বজ্রপানি বা ক্ষমতার প্রতীক। ভিতেরর দিকে পাথরের গায়ে নাওভাং ন্যামগিয়াল, গৌতম বুদ্ধ এবং পদ্মসম্ভবের ছবি খোদাই করা। চারদিকে বাগান এবং পায়ে হাঁটা পথ। পশ্চিমে সড়কের পাশ ঘেষে আরো দুটি ছোট কাঠামোর অবস্থান। উৎসবের সময় ভিত্তিকে বিভিন্ন রঙে রাঙানো হয়। ভিত্তিতে উঠলে চারদিক দিয়ে চারটি পাথরের কারুকাজ সমৃদ্ধ গেট দিয়ে এতে প্রবেশ করা যায়। গেটের সামনে পোর্টিকো অর্থাৎ পিলার এবং ছাদসহ বারান্দা। পিলার সোনালী রংয়ের কারুকাজে খচিত। বড় প্রার্থনার চাকাগুলো বামদিকে অবস্থিত। ছর্টেন স্মৃতিস্তম্ভ বহু প্রবীণ ভুটানকে প্রতিদিন আকর্ষণ করে যারা স্তুপার চারদিকে প্রদক্ষীণ করে, বিশাল লাল প্রার্থনার চাকা ঘোরায় এবং পবিত্র বেদীতে প্রার্থনা করে। চারটি প্রবেশ পথের মধ্যে ভক্তদের জন্য কেবল একটি প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত।
স্মৃতিস্তুপাটি চতুর্দিকে খোদাই করা সংযোজন দ্বারা সজ্জিত। এতে মন্ডল, মূর্তি এবং তৃতীয় রাজার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত একটি মন্দির রয়েছে। এর নিচতলা বজ্রকালয়া নামক বিদ্যা শেখার পরিসর। এতে চারটি বেদি রয়েছে যার প্রত্যেকটিতে রাজার বিভিন্ন ছবি রয়েছে; পূর্ব বেদিতে আছে বুদ্ধের চিত্র। নিচতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে আরো দুটি তলা সংযুক্ত যার প্রতিটি তলায় চারটি করে বেদি রয়েছে। একটি কেন্দ্রীয়ভাবে স্থাপন করা বৃহৎ কাঠের খোদাই মন্দিরের পিছনের তিনটি স্তরকে আবৃত করেছে। কাঠের খোদাইয়ে বেশিরভাগই ক্রদ্ধ দেবদেবীদের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি চিত্রিত করা। দ্বিতীয় স্তর থেকে ছাদে প্রবেশ করা যায়। তৃতীয় তলার ছাদ একটি রেলিং দিয়ে ঘেরা। দ্বিতীয় তলাটি আট প্রকারের মন্দ আত্মাকে বশীভূত করার জন্য কাগু বিদ্যালয়ের দ্রুকপা বিদ্যা শিক্ষার জন্য উৎসর্গীকৃত। একদম উপরের তলায় লামা গংডু শেখানো হয়। এই তিনটি তলা একত্রে র্ন্যিং-মা সম্প্রদায়ের অভিনব শিক্ষায়তন হিসেবে কাজ করে। দ্রুকপা কলার সমস্ত গ্রন্থগুলো একসময় পদ্মসম্ভব দ্বারা গোপন করা ছিল এবং যথাক্রমে ১৯শ, ১২শ এবং ১৪শ শতাব্দীতে গ্তের-স্তোন দ্বারা উদ্ধার করা হয়েছিল। উপরের তলায় একটি গ্যালারিতে র্ন্যিং-মা স্কুলের বিভিন্ন দেবদেবী এবং বার্ডো দর্শনের আরো বিভিন্ন অবস্থার চিত্র সাজানো আছে। গ্যালারি এমনভাবে সাজানো যে স্মৃতিস্তম্ভের পরিধির চারদিকে ঘুরে বেড়ানো যায় পাশাপাশি শহরের দৃশ্যও বেশ ভালভাবে দেখা যায়।
ভুটানের অন্যান্ন ধর্মীয় প্রথার মত এই স্মৃতিস্তম্ভেও কেবল ঘড়ির কাঁটার দিকে প্রদক্ষিণ করে প্রার্থনা করা হয়। মন্ত্র পাঠ করা হয় এবং বড় বড় লাল প্রার্থনার চাকা ঘুরানো হয়। মনলাম প্রার্থনা উত্সব (Monlam Prayer Festival) এখানকার একটি জনপ্রিয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। ভুটানের ধর্মীয় প্রধান জে খেপ্পো (Je Khenpo) এই অনুষ্ঠানের জন্য যারা জমায়েত হয় তাদের সম্বোধন এবং আশীর্বাদ করেন।