কুব্বাত আস সাখরা (আরবি: قبة الصخرة, হিব্রু ভাষায়: כיפת הסלע) (ডোম অব দ্য রক বলেও পরিচিত) হল জেরুজালেমের পুরনো শহরের টেম্পল মাউন্টের উপর অবস্থিত একটি গম্বুজ। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আদেশে ৬৯১ সালে এর নির্মাণ সমাপ্ত হয়। বর্তমানে এটি ইসলামী স্থাপত্যের সর্বপ্রাচীন নমুনা। এটিকে "জেরুজালেমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থান" ও "সমগ্র ইসরায়েলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থান" বলে উল্লেখ করা হয়। গম্বুজের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কাঠামো চার্চ অব দ্য হলি সেপালকারের মত। উমাইয়া স্থাপত্যে বাইজেন্টাইন প্রভাবের উদাহরণ এ থেকে পাওয়া যায়।
এখানে অবস্থিত সাখরা নামক পাথরের কারণে স্থানটি ধর্মীয় দিক দিয়ে গুরুত্ববহ।
টেম্পল মাউন্ট বা আল-হারাম আল-কুদসি আশ-শরিফ বলে পরিচিত স্থানের উপরে এটি অবস্থিত। ইহুদিদের দ্বিতীয় মন্দির এখানে অবস্থিত ছিল বলে বিশ্বাস করা হয় যা ৭০ সালে রোমানদের জেরুজালেম অবরোধের সময় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী ইসরা ও মেরাজের সাথে এই স্থানটি সম্পর্কিত।
গম্বুজটি টেম্পল মাউন্টের উপরে অবস্থিত। এখানে দ্বিতীয় মন্দির নামে পরিচিত ইহুদি উপাসনালয় ছিল। ৭০ সালে রোমানরা এটি ধ্বংস করে দেয় ও এর স্থলে দেবতা জুপিটারের মন্দির গড়ে তোলে। বাইজেন্টাইন আমলে জেরুজালেম খ্রিষ্টান অধ্যুষিত ছিল। ১০ হাজারের মত তীর্থযাত্রী যিশুর পদচারণার স্থান পরিদর্শন করতে আসে।
কুব্বাত আস সাখরা উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আদেশে ৬৮৯ থেকে ৬৯১ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়। চতুর্থ শতাব্দীতে ইহুদিদের বিদ্রোহের পর থেকে এই টেম্পল মাউন্ট উন্নয়নের বাইরে থেকে গিয়েছিল।
এর স্থাপত্য ও মোজাইক বাইজেন্টাইন চার্চ ও প্রাসাদের আদলে গড়ে তোলা হয়েছিল। এর দায়িত্বে দুজন প্রকৌশলী ছিলেন। একজন হলেন মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক বাইসানের বাসিন্দা রাজা ইবনে হায়ওয়াহ ও অপরজন হলেন খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের খ্রিষ্টান দাস জেরুজালেমের ইয়াজিদ ইবনে সালাম।
হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের শেলোমো ডোভ গোয়েটেইনের মতে কুব্বাত আস সাখরা অন্যান্য আরও কিছু স্থাপত্যের সাথে সমাপ্ত করার জন্য তৈরী হয়েছিল। এ. সি. ক্রেসওয়েল তার বই অরিজিন অব দ্য প্লেন অব দ্য ডোম অব দ্য রক এ উল্লেখ করেন যে স্থাপনাটি তৈরী করার সময় চার্চ অব দ্য হলি সেপালকারের মাপঝোক ব্যবহার করা হয়েছিল। এর গম্বুজের ব্যাস ২০.২০ মি. ও উচ্চতা ২০.৪৮ মি, অন্যদিকে চার্চ অব দ্য হলি সেপালকারের গম্বুজের ব্যাস ২০.৯০ মি ও উচ্চতা ২১.০৫ মি।
১০৯৯ সালে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম অধিকার করে নেয়। কুব্বাত আস সাখরা অগাস্টিনিয়ানদের দিয়ে দেয়া হয়। তারা এটিকে গির্জায় রূপান্তর করে এবং আল-আকসা মসজিদকে রাজকীয় প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। নাইটস টেম্পলাররা কুব্বাত আস সাখরার স্থানটিকে সুলায়মান (আ) কর্তৃক নির্মিত উপাসনালয়ের স্থান বলে বিশ্বাস করত। পরবর্তীতে তারা পার্শ্ববর্তী আল আকসা মসজিদে সদরদপ্তর স্থাপন করে।
১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর সুলতান সালাউদ্দিন জেরুজালেম জয় করেন। কুব্বাত আস সাখরাকে পুনরায় মুসলিম স্থান হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। এর চূড়ায় স্থাপিত ক্রুশকে সরিয়ে সেখানে ইসলামী চাঁদ স্থাপন করা হয়। নিচে পাথরের চারপাশে কাঠের আবরণ দেয়া হয়। সালাউদ্দিনের ভাতিজা আল মালিক আল মুয়াজ্জাম ঈসা ভবনের পুনর্গঠনের দায়িত্ব পালন করেন।
মামলুক শাসনের সময় কুব্বাত আস সাখরা গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় আসীন ছিল। মামলুকরা ১২৫০ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।
প্রথম সুলাইমানের শাসনামলে কুব্বাত আস সাখরার বহির্ভাগ টাইলস দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়। এ কাজের জন্য সাত বছর সময় লাগে।
অভ্যন্তরভাগ মোজাইক, ফাইয়েন্স ও মার্বেল দ্বারা সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। এর অধিকাংশই নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার কয়েকশত বছর পরে করা। এতে কুরআনের আয়াত লেখা রয়েছে। সূরা ইয়াসিন ও বনী ইসরাইল এতে খোদিত রয়েছে। সুলতান প্রথম সুলাইমানের সময় তা সম্পন্ন হয়।
১৬২০ সালে কুব্বাত আস সাখরার পাশে উসমানীয়রা কুব্বাত আন নবী নামক আরেকটি স্থাপনা নির্মাণ করে। ১৮১৭ সালে দ্বিতীয় মাহমুদের আমলে বড় ধরনের সংস্কার সম্পন্ন হয়।
মুহাম্মদ আমিন আল হুসাইনি ১৯১৭ সালে ফিলিস্তিন মেন্ডেটের গ্র্যান্ড মুফতি নিযুক্ত হন। তিনি কুব্বাত আস সাখরা ও আল আকসা মসজিদের সংস্কার করেন।
১৯২৭ সালের ১১ জুলাই ফিলিস্তিনে সংঘটিত ভূমিকম্পে কুব্বাত আস সাখরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিপূর্বে সম্পাদিত সংস্কারগুলো এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৫৫ সালে জর্ডান সরকার সম্প্রসারণমূলক পুনর্গঠন কাজ শুরু করে। আরব সরকারগুলো ও তুরস্ক এতে অর্থ সহায়তা দেয়। সুলতান সুলাইমানের সময় স্থাপিত বেশ কিছু টাইলস এসময় প্রতিস্থাপিত করা হয়। অতিবৃষ্টির ফলে এগুলো স্থানচ্যুত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে এই সংস্কারের অংশ হিসেবে গম্বুজটি এলুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ মিশ্রণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ১৯৬৪ সালের আগস্টে সংস্কারকার্য সমাপ্ত হয়।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধের সময় কুব্বাত আস সাখরার উপর ইসরায়েলি পতাকা উত্তোলনের কয়েক ঘন্টা পর মোশে দায়ানের নির্দেশে তা নিচু করা হয় এবং শান্তি রক্ষার স্বার্থে টেম্পল মাউন্টের তত্ত্বাবধানের জন্য মুসলিম ওয়াকফে দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৯৩ সালে গম্বুজের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য জর্ডানের রাজা হুসাইন ৮.২ মিলিয়ন ডলার দান করেন। তিনি তার লন্ডনের বাড়ি বিক্রি করেছিলেন। এর দ্বারা ৮০ কেজি স্বর্ণ অর্জিত হয়।
ইরানের ১০০০ রিয়াল নোটে কুব্বাত আস সাখরার ছবি রয়েছে।
জর্ডানের আওকাফ মন্ত্রণালয় স্থাপনাটি রক্ষণাবেক্ষণ করে।
২০ শতকের মধ্য ভাগ পর্যন্ত অমুসলিমরা এখানে প্রবেশ করতে পারত না। ১৯৬৭ সালের পর অমুসলিমরা সীমিত আকারে প্রবেশাধিকার পায় তবে অমুসলিমদের এতে প্রার্থনা বা কোনো ধর্মীয় চিহ্ন বা হিব্রু অক্ষর নিয়ে আসার অনুমতি নেই। ইসরায়েলি পুলিশ এই নিয়ম কার্যকর করে। শুধুমাত্র মুসলিম ছুটির দিনেই পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি বাসিন্দারা প্রবেশ করতে পারে। ৩৫ বছরের বেশি বয়সের পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরাই প্রবেশ করতে পারে। ইসরায়েলি রেসিডেন্সি কার্ডধারী জেরুজালেমের বাসিন্দা ও ইসরায়েলি নাগরিকত্বপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনিদের প্রবেশে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
২০০৬ সালে গ্রীষ্মের সময় সকাল ৭:৩০ থেকে ১১:৩০ ও দুপুর ১:৩০ থেকে ২:৩০ এবং শীতের সময় সকাল ৭:৩০ থেকে ১১:৩০ ও দুপুর ১:৩০ থেকে ২:৩০ এর জন্য অমুসলিমদের প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। ২:৩০ এর পর থেকে অমুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ এবং শুক্রবার, শনিবার বা মুসলিম ছুটির দিনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পশ্চিম দেয়ালের প্রবেশ পথের পরে একটি কাঠের হাটাপথ দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। অমুসলিমদের মসজিদ, কুব্বাত আস সাখরা ও তুলার বাজারের মধ্য দিয়ে প্রবেশে নিষেধ আছে। দর্শনার্থীদের কঠোর নিরাপত্তা নিয়ম মেনে চলতে হয় এবং ইহুদি প্রার্থনার বই এখানে নিষেধ।
অনেক অর্থোডক্স রেবাই এখানে প্রবেশকে ইহুদি আইনের বিরোধী মনে করেন। তাদের বিশ্বাস মোতাবেক ৭০ সালে জেরুজালেম অবরোধ হওয়ার পর থেকে এ স্থানের সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান যাতে শুধু প্রধান পুরোহিত প্রবেশ করতে পারতেন তা অজ্ঞাত হয়ে পড়ে। তাই তাদের মত হল পুরো এলাকায় প্রবেশে নিষেধ। তবে কিছু রেবাইদের মতে আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য প্রমাণ তাদেরকে স্থানটি চিহ্নিত করতে পারে যাতে ইহুদি আইন লঙ্ঘন না করে তাতে প্রবেশ করা যায়। তবে তারাও ইহুদিদেরকে কুব্বাত আস সাখরায় প্রবেশে নিষেধ করে।